মিলনের শ্বাসরোধী কথা
এত পা কোথায় ছিলো কে বলবে! আনখা মচমচ শব্দে আলগা সকাল টানটান হয়ে উঠে বসে। অলস আড়মোড়া ভাঙার দিন নয় আজ। যেন কোথায় কী একটা ঘটে যাচ্ছে, চাপা গলায় কেউ কাউকে শাসায়, কী যেন ঘটেছে—ভীষণ, ষড়যন্ত্রমূলক একটা কিছু।
কথামালার আঢাকা দুধে মাছি বসে। আজ তাড়িয়ে দেবার সাহস পাই না। এভাবে সকাল হলে মানুষের মুখ চেনা দায় হয়। কে কার দলে, ঠিক বোঝা যায় না। ভয়ে ভয়ে কথার দিকে তাকাই। তারপর জানলার দিকে। ফের কথার দিকে। জানলা। আবার কথা। মচমচ শব্দ এবার বাড়তে থাকে। লেফট রাইট লেফট। আমি শিউরে উঠে কথার দিকে তাকাই। ফরসা শরীর ইঙ্গিতবহভাবে আজ যেন বেশি নগ্ন দেখায়। আমার দেখতে দেখতে শীত লাগে। পাঁচ বছর ধরে এইরকম চলে আসছে। এইভাবে, ঘুম থেকে উঠে, কথার খোলা শরীর। এরকমই খুলে শোয় কথা। যাতে ঘুম ভাঙলেই আমি ইচ্ছেমতন ঘাঁটতে পারি। নাড়তেচাড়তে পারি। পাঁচবছর ধরে যাতে ঠাহর করতে না পারি ওর বোঁটার রঙ কালো না গাঢ় নীল। কেন এমন করে থাকে কথা? কেন যথেচ্ছ ব্যবহৃত হতে চায়? কোনো শেষ প্রতিহিংসা নেবে বলে? আজ, নেভি ব্লু রঙের বৃত্তটা ওর ইউনিফর্ম বলে ভ্রম হয়। ইউনিফর্ম? নাকি গোপন সামরিক চিহ্ন? অথচ কথামালা কখনো গোপন করেনি। প্রতিদিন বুক খুলে আমার শেষ পরিণতির কথাই জানান দিয়েছে। যেন এতই অমোঘ। যেন পালাবার প্রশ্ন এতই অবান্তর। না, কথামালা আমায় ঠকায়নি। যে মানুষ দেখেও দেখে না তাকে ঠকাবার দরকার নেই।
পাঁচ পাঁচটা বছর এভাবে কেটেছে; আমি, মূঢ় আমি, কিছুই বুঝিনি। বুকের মধ্যে বড়োরকম ঠকে যাবার কষ্ট হয়। ইচ্ছে করে কথার পাছার নরমে মুখ রেখে ফুলে ফুলে কাঁদি। কিন্তু আজকে কথাকে ছুঁতে সাহস হয় না। ওর বাড়াবাড়ি লাবণ্য, প্রয়োজনের বাড়তি সুষমা আজ সন্দেহজনক লাগে। অভিসন্ধিমূলক। আমি মাথা নামিয়ে খুব কাছ থেকে ওর নীল দুটো দেখি। বুঝবার চেষ্টা করি। একজোড়া দুগ্ধস্রাবী বোঁটা, যেমন সবার থাকে। তবে সবার যা থাকে না তেমন নাম আমি ওদের দিয়েছিলাম। কথা দিয়েছিল। আমার- কথার দেওয়া ভালোবাসার অনেক নামপদ। তারা কি বঞ্চনা করতে পারে? আজ তবু যৌথতার ভাঁড়ার বুটের মচমচ শব্দে ভরে গ্যালো; ওদের মধ্যে যার নাম চিত্রকূট তার নাম এবার বদলানো যেতে পারে। ওদের মধ্যে যার নাম পিপুল সে হয়তো ওই নামে আর সাড়া দেবে না। ওদের নতুন নাম হতে পারে রাইফেল বা উস্কানি। কিংবা আরো ভালো আরো উপযুক্ত কিছু। ঠিক বুঝতে পারি না। কথাকে জাগাই। ভর হওয়া লোকের মতো ঝাঁকাতে থাকি।
কথামালা প্রশ্নকাতর চোখ খুলে তাকায়। যেন সদ্য ঘুম থেকে উঠলো না, যেন কখনো ঘুমোয়নি এভাবে হাসে। বলে, লাগছে তো।
আমি বলি, ওদের নাম পাল্টে দিয়েছি।
কথা বলে, কাদের?
ইউনিফর্মদুটোর।
কথার অবাক ভঙ্গিতে একটু ঘোলাটে ভাব আসে। কিন্তু সে কিছু বলে না। আমি মনে মনে মেলাই। কথামালা প্রতিবাদ করে না। উড়িয়ে দেয় না। গোপন করার কিছু নেই। নিঃশঙ্ক ভঙ্গিতে তাকায়। তার মেনে নেবার ভঙ্গিতে আমার ফের শীত ধরে। কথা আমার গাল ছোঁয়, পাঁচবছর ধরে, রোজ, যেভাবে ছুঁয়েছে।
শব্দটা পাচ্ছিস?
কীসের?
বুকে দুধ আসার শব্দ? আসছে।
যাঃ!
কথা ব্রায়ের স্ট্র্যাপ থেকে হাত নামায়। আমাকে টেনে নেয় বুকে।- দ্যাখ!
কথা মিথ্যে বলে না। সত্যি সত্যিই যেন ক্ষীণ সুদূর থেকে সাগর গর্জনের শব্দ। শব্দের প্রতীতি। এত সংক্ষোভ কীসের ওই বুকে? তবু তার গাঢ় খাঁজে ঝাউবনের ছায়া ঘনায়। কথার আস্নানস্নিগ্ধ বুকে। স্নানশীতল।
কথামালা আমায় ছেড়ে দেয়। হাসে। জামা পরতে থাকে। পেনসিল স্কার্টের নীচ থেকে পায়ের উপবন। নীরোম। চন্দ্রনিষিক্ত ত্বক। কথামালা পা দিয়ে পায়ে ঘষে। তাকায়। হাসে। আকাঙ্ক্ষার মদির বেদনা সারা ত্বক চুঁইয়ে পড়ে। কথা বলে, দ্যাখ, কেমন তেল গড়াচ্ছে!
তলপেটে চিনচিন ধরে আমার। শান্তি নেই। চিরঅতৃপ্তির নেশা বুকে নিয়ে জন্মেছি। কথামালার মতন স্নানশুচি হওয়া এ- জন্মে হল না আমার।
তলপেট বেয়ে ঘাম গড়ায়। একটা বিন্দু মধ্যমার ডগায় তুলে কথাকে দেখাই। দেখুক। দ্যাখো কথামালা, আমার আতঙ্কের মুখ দ্যাখো। ভয়ের কী তরলতা দ্যাখো। কথা চুল খুলে একটি বিন্দু মেখে নেয়। কথার অঢেল চুলে।
অরণ্যে লুকিয়ে থাকে তার ভয়। জানে, পথিক তো এপথ দিয়ে যাবেই। কথামালা জামা খোলে, নগ্ন হয়। কথামালার পরা- ছাড়ার খেলা। নেহাত মন্দ না। কেন যে খেলে কে বলতে পারে! কার বিরুদ্ধে, কার সঙ্গে, খোলে? শরীর তো বিছিয়ে থাকে কথামালা! Like a patient etherized upon a table.
আকাশ অংশত মেঘলা। ত্বক কথা বলে। হালকা রোদের ঝাঁঝ। কথামালা ঘড়ি হয়ে যায়। প্রকান্ড টিকটিক বাজতে থাকে।
ঘড়ি কথা বলে। আমি বালিশে মুখ গুঁজে ঘুম খুঁজি। নীরবতা। বুটের গম্ভীর শব্দ মুছে যায়। কথা মুছে যায়।
রোদের ঠমকে ঘুম ভাঙে। কথামালার দুধসাদা স্তন পৃথিবীর মতন আমার দৃষ্টি আটকে আছে। আমি কিছু বলতে চাই। বলতে পারি না; গোটা একটা বোঁটা আমার মুখে ঢোকানো। শীতল নলের মতো। মনে পড়ে যায়, আমি ওর বোঁটার নাম দিয়েছি রাইফেল। দম আটকে আসে। আমি টের পাই আর পালাবার পথ নেই। পিছোবার রাস্তা নেই। আমি বুঝতে পারি কথার তাজা শরীরের ঘ্রাণ ভুলে মরে যেতে আমার কষ্ট হবে। মরতে আমি কখনো চাই নি। চাই না। একবার শেষবারের মতো ডাকতে চাই, কথা, কথামালা...
মুখের মধ্যে নল, ছিটকে যে গোঙানি বেরোয় তার অর্থ হয় না। হলেও, কথামালার বালিশের নীচে তার ঘুমের অতলে সেই অপশব্দ পৌঁছবে কি?