74Th pOsT : চান্দ্রেয়ী দে


আমার গল্পনায় একটি মাজারী মেয়ে


ফিরে এসে যেতে চাইছি যেখান থেকে ফিরলাম। দুঃখমুদ্রা দেখে ফেললাম আজ হঠাৎ- কারে কয় দুঃখমুদ্রা!
মাগো সেই মুদ্রা আকাশের দিকে নয়; সে মুদ্রা নেই মানুষের আঙুলে; এক পাগল দেখি হেঁটে যাচ্ছে- একহাতে নাইলনের নোংরা বস্তা, আর, অন্যহাতে আহা মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা দুঃখমুদ্রা নিয়ে।
যেতে যেতে পথ কম পড়ে গেছে বুঝি! যাচ্ছি হয়তো। হয়তো ফিরছি পাগলা বাবার মাজার থেকে, অথচ পাগলা বাবা সেখানে নাই। আটশো বছর আগে ছিল পাগল উরফ হজরত মাকসুদ গাজী। ছিল, তাই আছে। ছিল=আছে ।
আটশো বছর আগে কালদিঘীর ধারে ছিল এক পাগল; তাই পাগল আছে রাস্তায় রাস্তায় মুদ্রায় মুদ্রায় মুহুর্মুহু।আর ছিল বাবার মাজারের পাশে একখানি কুটীর- ‘ভরত কুটীর’- শাদা পাথরে লেখা আছে সাদা বাংলায়। পাথর ও অক্ষর উভয়েই অক্ষত, অথচ ক্ষতস্থান বেরিয়ে পড়েছে কুটীরের সর্বত্র- কুটীরের ছাত ভাঙ্গা, দরজায় জানলায় গড়ে উঠেছে গাছ- খসা ধ্বসা কুটীর একখানি। যেন হজরত মাকসুদ গাজী ও ভরত, দুই সখা, আটশো বছর আগে পাশাপাশি বসে ছিল কালদিঘীর পাড়ে। ছিল- তাই আছে কুটীর ও মাজার- আটশো বছর ধরে – মানুষগুলি পাহারা দিচ্ছে পাগলের স্মৃতি। কেউ তিরিশ। কেউ পঞ্চাশ। মানুষগুলি দূরের।
মনে হয় পথ বুঝি কম পড়ে যাবে। শত শত বছরের পুরোনো কাচের কাজ ঘিরে থাকবে আরেক মাজার- হজরত বাবা লাট্টু শাহ চিশতি-র দরবারে দেখা হয়ে যাবে দুইজন নীরবতার সঙ্গে- দুইজন মাজারকর্মী। এদের মধ্যে একজন বোবা, ইশারায় বলে দেয় প্রবেশের পথ, নীরবে পরিষ্কার রাখে প্রবেশের পথ। কাচ ও পাথর ও চাদর ও নজরানার সাম্রাজ্যে দাঁড়িয়ে অপরজন শুধু বলে- কিছু নেই! কিছু নেই! শত শত বছর আগে ছিল, তাই নেই। ছিল=নেই। এখন কিছুই নেই। হাত-পা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে অস্থির হয়ে ওঠে সে, প্রশ্ন করলে বিরক্ত হয়ে তাকায়, তাড়িয়ে দিতে চায়, তার শরীর বলে ওঠে কিছু নেই কিছু নেই। কুতুবুল আউলিয়া সৈয়দ মহম্মদ লতিফুদ্দিন শাহ উরফ হজরত বাবা লাট্টু শাহ চিশতি উরফ মাজার উরফ কুরআন শরিফ উরফ প্রার্থনা উরফ নীরবতা উরফ দুইজন মাজারকর্মী- একজন বোবা; অপরজনের বলার কিছুই নেই। অপূর্ব স্থাপত্য এক, অপূর্ব গন্ধ, আতর ও গোলাপজল, মানুষ ও মসজিদ- অথচ কিছুই নেই। ভ্রমণভ্রমর এসে বসে আছে মাজারফুলে। শত শত বছর ধরে সে যদি উড়ত, হায়, শত শত বছর আগে ছিল মাজারফুলে মধু- এখন কিছুই নেই।
এভাবেই গেলুম। টের পেলুম ভোর হয়েছে যেই, টের পেলুম সে এসে গুঞ্জন করছে কানের কাছে- উড়তে উড়তে যাচ্ছে ভ্রমণভ্রমর- এভাবেই গেলুম। মাথায় তুলে নি্লুম সফেদ ঘোমটা, জলের ছোঁয়া নিলুম হাতে, দাদাপীরের মাজারের পাশে দেখলুম পড়ে আছে জ্যান্ত মানুষের মাজার। উলঙ্গ শিশু ও রাজহাঁস, কুকুর ও রামছাগল, মেয়েপুরুষ ও চায়ের গুমটি পাশাপাশি ঘুমিয়ে রয়েছে। ভোরের গন্ধের সঙ্গে ধূপের গন্ধ মিশে আমাকে এমন আড়াল করল কি বলবো!
হারিয়েই যাচ্ছিলুম, হঠাৎ শুনি বিনবিন রিনরিন কান্না- আহা অমন কান্নার ঝর্ণা আগে তো দেখিনি- পাথরের উপর কে যেন ঢেলে দিচ্ছে চোখের জল- পা রাখলুম শীতল পাথরে। দূউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউর থেকে দাদাপীরের পায়ে ধর্ণা দিয়ে পড়ে আছে একটি সাধারণ বউ। একটি সাধারণ মেয়ে ধীরে প্রদক্ষিন করতে লাগল তাকে। ইনিয়েবিনিয়ে আসা কান্নাধ্বনি কাছে গেল দূরে এল দূরে গেল কাছে এল গেল এল এল গেল- প্রদক্ষিণ করতে লাগলুম কান্নাধ্বনি। ওহো ভোর, ভ্রমণভ্রমর যেন এসেছে মাজারবাগানে।
মাজারফুলের পাশে কবরের ফুল। সেই ফুল মেয়েছেলে ছুঁতে পারেনা। দূউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউরথেকে শুধু চোখ চেয়ে দেখা জালের ওপারে ঐ কবরস্থানের ছবি। কবরে প্রবেশ পায়নি মেয়েছেলে। একটা দিন, বচ্ছরকার একটাই দিন, মৈরমের (মহরম) দিন মেয়েছেলের জাল থাকে খোলা- ছেলে ও মেয়েছেলে উভয়েই প্রবেশ পায় সেদিন।
হায় হাসান! হায় হোসেন! কবরে মেয়েছেলে প্রবেশ করেনি? কবরে নেমে গিয়ে কারাবালা মেয়ে চিৎকার করেনি কখনো-
হায় হাসাআআআন! হায় হোসেন!
যেহেতু এটুকু সত্য যে আমি মেয়েছেলে, ফলে ভ্রমণভ্রমর অংশত কল্পনাই। কবরের ফুলে উড়ে বসতে যার নিষেধ- নিশ্চিত সে ভ্রমর কাল্পনিক- আর হায়, সেই কবরও কাল্পনিক। শোনো হে কাল্পনিক কবর, আমি গল্প বলছি মেয়েছেলে; মানুষের ফেরার পথে আমি দেখেছি পাথরের কবুতর যার মাথা ভাঙ্গা আর যার পাশে স্থবির দাঁড়িয়ে থাকে জ্যান্ত গাই। মাজার আর মাজারের মাঝে দেখেছি ‘প্রভু যীশুর সাইকেল দোকান’- আমি দেখেছি আছে।
আছে তাই ছিল- কবরে প্রবেশ ছিল সকল ভ্রমরের- ছিল তাই আছে। ওহো ভোর, পাগলা বাবার মাজারের পাশে নগ্নভগ্ন ভরত কুটীর যে আছে! আর আছে পাগলিনী। পাগলিনী হেঁটে যাচ্ছে পৃথিবীর কোথা থেকে কোথায়- আর এমন মাজার সবই সকলই ছিল তাহার দুঃখমুদ্রা।