আড়াল
বিশেষত্বহীণ পাঁচিলটা শ্যামলের
দৃষ্টি খেয়ে নিচ্ছিল। হাতের চা শেষ হতে চাইছে না। শ্যামলের চোখ খুঁজছে যা যা কিছু,
তার সবই যেন আড়াল করে রেখেছে ছ’ফুটি পাঁচিল। আসমা আসেনি। আসবে কিনা আসমার বাপ ছাড়া কেউ
জানেনা। শ্যামল দেখে বাচ্চাগুলো ইট ঘষে লিখে দিল পাঁচিলের গায়- ‘কবুল হ্যাঁয়’। চায়ের ভাড় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শ্যামল দৌড়ায় বাচ্চাগুলোকে ধরবে বলে। রাস্তার এপাশে
এসে তাদের আর খুঁজে পায়না। অসহায় ভাবে পাঁচিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কবুল হ্যাঁয় এর
বদলে তখন পাঁচিল হয়ে,- মায়া তার জন্য ছ’ফুট দাঁড়িয়ে আছে।
“আমি আর আসবো না শ্যামল!”
“হুম...”
“তাও কি তোমার ইচ্ছে করে না আমায় দেখতে?”
“...”
“আমার চোখের থেকে
বেশিকিছু জানতে ইচ্ছে করে না?”
“কাল এসো।
পাঁচিলের ওখানে।”
“এই শেষবার
শ্যামল। আর পাবেনা।”
“জানি।”
সন্ধ্যার মুখে ফোন রাখে শ্যামল।
পাঁচিলের সামনে সে তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। এই পথে যান চলাচল সীমিত। শ্যামলের ভাবতে ভালো
লাগে পাঁচিলের ওপার ভরে যেন মেলা বসেছে,- রাসের। নাগরদোলার প্রতিটা খোপে আসমা-
শ্যামলেরা দুলে চলেছে। মেলার কোলাহল কোথা থেকে তার কানে ঢুকে পরে সে বোঝেনা। তার
ভালো লাগে, পাঁচিলের ওপার তাকে ভাবায়। আসমা জানতে চেয়েছিল। চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস
করতে বলেছিল “ওপারে কী আছে?” শ্যামল যায়নি। শ্যামলের ভাবতে ভালো লেগেছিল ওপারের বাগান বাড়ির কথা। বিশেষ
দিনে সেখানে পিকনিক হয়। ২৫ শে ডিসেম্বরগুলোয় শ্যামল ওপাশ থেকে রান্নার আওয়াজ,
গানের কলি শুনতে পায়। শ্যামলের ভালো লাগে। সন্তুষ্ট হয়ে সে বাড়ি ফেরে। কাল আসমা আসবে। অনেক দেখা বাকি।
“তুমি আমায় দেখতে চাও না কেন?”
“তোমার চোখ ছাড়া আমার আর কিছুই চাইনা তাই...”
“আম্মা বলেন আমার নাক, ঠোঁট নাকি হুরি-পরিদের মত, তোমার কখনও তা দেখতে ইচ্ছে
করে না?”
“না বললাম তো!”
“তুমি পালাতে চাইছো শ্যামল!”- বোরখার আড়াল থেকে আসমার আর্তস্বর ছড়িয়ে আসে।
“কেন পালাবো! কোথায়!”
“জানিনা।” আসমা, আলাপের তৃতীয় মাসের চতুর্থ
দিনে হাল ছেড়ে দেয়।
শ্যামল আসমাকে দেখেনা। দেখেও দেখে
না। তাই সে ভেবে চলে। বাসে-পথে-ট্রেনে আসমা চোখের মেয়েদের দেখে শ্যামল আরাম পায়।
শহর ভরা আসমাদের সাথে সাথে সে চলাচল করে, এক সময় পাঁচিলের সামনে এসে দাঁড়ায়।
দুর্গাপুজো হচ্ছে ওপারে। ঢাকের শব্দে কান ভরে যায় শ্যামলের। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে
সে নিশ্চিন্তে ঘরে ফেরে। আসমা আসে, আসমা যায়। আসমার বাপ ওর নিকাহ্ ঠিক করেছেন। শ্যামল
চোখ বোজে নিজের খাটে। শ্যামল চোখ থেকে এগোয়নি, চোখ থেকে নামেনি। আসমার আশ মেটেনা।
আসমা আশ মেটাতে কাল আসছে।
সকাল থেকে শ্যামল চায়ের দোকানে
বসে। সকাল থেকে পাঁচিলের ওপারটা শ্যামলের ইচ্ছে মত বদলে চলেছে। ওপাশ থেকে ভেসে আসা
নির্বাচনী প্রচার থেমে গিয়ে যখন কিছুই শোনা যাচ্ছে না তখনই আসমা এসে দাঁড়ালো
শ্যামলের সামনে।
“কি ভাবছো?”
“নদীর শুকনো চর।”
“ওপারে?”
“হুম...”
“যাবে?”
“না আসমা।”
“কেন?”
“যতক্ষণ আমি এখানে এপাশে বসে, ততক্ষণ ওপারে যা খুশি হতে পারে, ইচ্ছে মত।
ওপারটা জেনে গেলে আর আমার কথা
খাটবে না।
ওপাশে হাসপাতাল থাকলে তাই থাকবে,
বাগান বাড়ি থাকলেও তাই।”
আসমা তাকিয়ে থাকে শ্যামলের দিকে।
“কি?”
“আমার ক্ষেত্রেও কি এটাই খাটে?”
শ্যামল ভয়টা চাপতে চায়। “না আসমা! আমি জানি তোমার
ঠোঁট, নাক, চিবুক কেমন...”
“কি ভাবে জানলে?”
শ্যামল আসমার চোখে চোখ রাখতে পারে
না। “আমি জানি আসমা।
আমি তোমায় দেখেছি।”
“কোথায় দেখেছো?”
“বাসে, ট্রেনে যাওয়ার সময়...” শ্যামল চুপ করে যায়। নখ খুঁটতে থাকে। আর তখনই ওপাশ থেকে
নদী গন্ধওয়ালা বাতাস শ্যামলের নাক মুখ দিয়ে ঢুকে আসে। শ্যামলের ঠান্ডা লাগছে।
“আমার দিকে তাকাও শ্যামল... আমি আর আসবো না। তোমায় আমার কথা আর ভাবতে হবে না।”
শ্যামল মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
“তাকাও আমার দিকে! আমি তোমার ইচ্ছেয় চলি না শ্যামল। আমার যা আছে, তা আমার।
তোমার চাহিদা অনুসারে তা কখনোই বদলাবে না। এটা বোঝ!”
“আমি তোমায় বদলাতে চাইনা আসমা। তুমি যা আছো, তুমি তাই।”
“তাহলে...”
“তাহলে কি?” শ্যামল তাকায় আসমার দিকে।
আসমা একটানে বোরখার আড়াল সরিয়ে
দেয়।
ভীষণ আলো এসে পড়ছে শ্যামলের চোখে।
সে চোখ খুলে রাখতে পারে না। একসময় তাকিয়ে দেখে আসমা চলে গেছে। চায়ের দোকান ফাঁকা।
শ্যামলকান্তি উঠে পড়ে। আর সে
কোথাও আসমাকে পাবে না। আসমা চোখের মেয়েরা উবে উবে যাচ্ছে শহর থেকে হুরী পরিদের মতো। শ্যামল পাঁচিলের
সামনে এসে দাঁড়ায়। ওপারে কি আছে সে জানতে চায়না। আড়ালে কি আছে ভাবতে তার ভালো
লাগে। ওপাশ থেকে শঙ্খচিলের ডাক তার কানে পৌঁছয়। শ্যামল কান চেপে ধরে পাঁচিলের গায়।
পাঁচিলের বুকে কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকে।